মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কুমারবিষ্ণু দে
Thursday, 20 January 2011
Tuesday, 6 July 2010
Malay Roychoudhury's Interview by Prof Kumarbishnu Dey
মলয় রায়চৌধুরীর এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন 'স্বপ্ন' পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক কুমারবিষ্ণু দে । সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছিল মলয় রায়চৌধুরীর তৎকালীন বাসা কলকাতার নাকতলার ফ্ল্যাটে ১৮ জুন ২০০৭ এবং 'স্বপ্ন' পত্রিকার শারদ ১৪১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ।মলয় রায়চৌধুরী এখন মুম্বাইতে থেকেন। এটি ছিল পত্রিকাটির বিশেষ মলয় রায়চৌধুরী সংখ্যা ।
ডক্টর দে: একজন লোক কেন লেখে ? কেন ?
মলয়: সবাই একই কারণে লেখেন না । প্রতিটি লেখা একই কারণে রচিত নয় । একই লোক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বয়েসে একই কারণে লেখেন না । আমার মনে হয়, আমি লেখালিখি শুরু করেছিলুম প্রাকযৌবনের উচ্ছৃঙ্খল সাহিত্যপাঠ, বঙ্গসংস্কৃতিতে আউটসাইডার-বোধ, পারিবারিক গোঁড়ামি, সাবর্ণ চৌধুরী ক্ল্যানের সীমালঙ্ঘনের প্রেক্ষিতে ।
আমি যে কেন লিখি, এই অমূলক প্রশ্নটা আমার কোনো ভারবাহী জিঞ্জাসাবোধের অন্তর্গত ছিল না যদিও, একটি দার্শনিক সমস্যা হিসাবে প্রতিনিয়ত আমাকে এমনভাবে চিন্তিত রেখেছে যে, প্রশ্নহীনতা, চিন্তাহীনতা, এমনকি চেতনাবোধ গুলিয়ে ফেলেও, আমার লেখার সম্ভাবনা থেকে, লিখিত পাঠবস্তু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার, কোনো সদুত্তর পাই না । আমার মধ্যে আমার লেখার প্রক্রিয়াটি নিজে, ওই প্রশ্নটির সঠিক উত্তর । আমি কেন লিখি, এই সমস্যাটি, সারাজীবন একই দার্শনিকতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত থাকতে পারে না , কেন না, একজন মানুষের মানসিক অবস্হানগুলোর সুস্পষ্ট জলবিভাজন থাকে না ।
যাঁরা মার্কসবাদী, গান্ধিবাদী, রামকৃষ্ণ অথবা শ্রীঅরবিন্দে বিশ্বাসী, কিংবা রাজ্য সরকার বা রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলেছেন, তাঁদের, মনে হয়, এই সমস্যাটির হাঙরের হাঁ-মুখে পড়তে হয় না । লেখালিখিটা যাঁদের ব্যবসা, তাঁরা তো জানেজই কেন লিখছেন; তাই বলে আমি মনে করি না যে তাঁদের নিজস্ব অবস্হানের জন্যে তাঁদের অশপদ্ধা করতে হবে ।
ডক্টর দে: আপনি কি হিন্দু ?
মলয়: হ্যাঁ, আমি হিন্দু । কিন্তু একেশ্বরবাদ ও অরগ্যানাইজড রিলিজিয়নে বিশ্বাসী নই । আমি প্রকৃতিকে ডিভাইন বলে মনে করি । প্যাগান হিন্দুর মতো জল, আলো, বাতাসকে ডিভাইন মনে করি । তাদের নিয়ে কবিতা লিখি না ।
ডক্টর দে: আপনি হাংরি আন্দোলনের ইশতাহারে বলেছেন 'ঈশ্বরের মৃত্যুসংবাদ অনেক-কাল আগেই পেয়ে গেছি, এখন আমিই আমার নিয়ন্ত্রক ও কর্ণধার । এখানেই কবিতার শুরু ।' বিষয়বক্তব্যকে একটু সহজ করে বলুন ।
মলয়: ব্যাপারটা বুঝতে হবে দেশভাগোত্তর বাঙালির উত্তর-ঔপনিবেশিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে, যখন হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হল । ইউরোপে রেনেসাঁসের হর্ষোল্লাসে ঈশ্বর প্রণীত নিয়ম-শৃঙ্খলার ভাঙনকে মুক্তি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল, এবং ঈশ্বরের সিংহাসনে বসানো হয়েছিল ব্যক্তি-মানুষকে । পরিবর্তনটি ভূমিকম্প ঘটিয়ে দিয়েছিল মানব-সমাজে; প্রথমে ইউরোপে, এরপর ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ যে ভূখণ্ডে গেছে, সেখানে । প্রতিটি ঊপনিবেশে সেখানকার দেবী-দেবতা ও আরাধ্য ইষ্টকে মেরে ফেলতে ইউরোপ যে সফল হয়েছিল শুধু তাই নয়, সেসমস্ত দেশের ইউরোপীয় মূল্যবোধ প্রভাবিত ভূমিপুত্রদের মধ্যে এই চিন্তাচেতনাকে ইতিবাচক গরিমা দিতে পেরেছিল । তার আগে প্রতিষ্ঠা দেবার জণে ব্যক্তি-মানুষকে বলা হত দেবতুল্য, সাক্ষাৎ ভগবতী ।
ওই নবজাগৃতির ভাবকল্পটি ঈতিহ্যগত প্রভূত্ববাদের জায়গায় 'জোর যার সত্য তার' এই আধিপত্যবাদকে যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা, ব্যক্তি-এককের ক্ষমতা প্রয়োগের আহ্লাদ ইত্যাদি তর্ক দ্বারা ন্যাজ্যতা দেবার প্রতিপাদ্য গড়ে তুলেছিল, যা শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদের কাঁধে আধুনিকতাবাদকে চাপিয়ে প্রকৃতির সৃষ্টিগত জটিলতা ও সমগ্রতা থেকে ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল ।
প্রাক-ঔপনিবেশিক বঙ্গসমাজে তাই প্রকৃতি-সংস্কৃতি বাইনারি অপোজিশান ছিল না । বাংলায় প্রকাশিত প্রথম হাংরি ম্যানিফেস্টো দ্যাখো । এই আরণ্যকতার উল্লেখ আছে । ওই বাইনারি অপোজিশান বা বলা যায় সব রকমের বাইনারি অপোজিশান বর্জন করেই কবিতা লেখার কথা বলেছিলুম ।
ডক্টর দে: আপনি বলেছিলেন আত্মার ইরিটেশা থেকে হাংরি কবিতার জন্ম । 'আত্মার ইরিটেশান' ভাবকল্পটা একটু সহজ করে উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলে কঠিনতা দূর হয় ।
মলয় : ঝিনুকের মধয়ে বালুকণা ঢুকলে যে ইরিটেশান হয়, তার দরুন মুক্ত তৈরি হয় । কবি যেহেতু সর্বব্যাপী এবং নিজেকে নিজে জানেন, তাই আত্মা শব্দটা প্রয়োগ করেছিলুম । আরো জানার প্রক্রিয়া থেকে ইরিটেশান হয়, যার দরুন বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানে প্যারাডাইম শিফ্ট ঘটান । হাংরি আন্দোলনকারীরা প্যারাডাইম শিফ্ট ঘটাবার চেষ্টা করলেন সাহিত্যে ।
ডক্টর দে: আপনার কবিতাকে কেন হাংরি বলা হবে ?
মলয়: কেননা আমি কবিতা থেকে কিচ্ছু বাদ দিইনি । কবিতা হাঁ-মুখে ছিল সবই গ্রাহ্য । অমুক হলে কবিতা হবে না, তমুক হলে কবিতা অসফল, এই ধরনের তর্ক সদ্য উত্তর-ঔপনিবেশিক বাংলায় মনে হত বুদ্ধিহীন ।
ডক্টর দে: 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতায় কিসের ক্ষুধার কথা বলা হয়েছে ?
মলয়: কবিতাটা নিজেই তার হাঁ-মুখে জীবন, যৌবন, মৃত্যু, যৌনতা, প্রেম, বাবা-মা, সমাজ, সময়, ইতিহাস সবাইকে পুরে নিতে চাইছে । এবং তা দ্রুতি- আক্রান্ত ।
ডক্টর দে: আন্দোলনের জন্য ইংরেজি 'হাংরি' শব্দটা ব্যবহার না করে 'ক্ষুধার্ত' শব্দটা ব্যবহার করলে কি আন্দোলনের ক্ষেত্রে সঠিক শক্তি পাওয়া যেত না ?
মলয়: না । ক্ষুধার্ত শব্দটায় ব্যক্তির আর্তির লেজুড় রয়েছে । ব্লান্ডার হয়ে যেত । শক্তি চট্টোপাধ্যায় করেছিলেন 'ক্ষুৎকাতর'; তাও গ্রাহ্য হয়নি । হাওয়া খাওয়া, পালটি খাওয়া, লাথি খাওয়া, গোঁত্তা খাওয়া, ঘুষ খাওয়া ইত্যাদির মজা ওই আর্তি বা কাতরতায় নষ্ট হয়ে যায় । খাওয়া তো সর্বগ্রাসী ।
এতদিনে হাংরি শব্দের উৎস-সূত্র আর দার্শনিক প্রেক্ষাপট জেনে গেছ নিশ্চই । না খেতে পেয়ে মরা বা যৌন ক্ষুধার সঙ্গে হাংরিকে সম্পর্কিত করেছিলেন প্রধানত সাংবাদিকরা ।
হাংরি শব্দটা আমি পেয়েছিলুম ইংরেজি ভাষার কবি জিওফ্রে চসারের 'ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম' বাক্যটি থেকে । উনি কালখণ্ডকে হাংরি রুপে চিহ্ণিত করেছিলেন ।
ওই সময়ে আমি হাতে পাই অসওয়াল্ড স্পেংলারের বই দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট । স্পেংলার বলেছিলেন যে সমাজ-সংস্কৃতি হল জৈব প্রক্রিয়া । তা যখন কেবল নিজের সৃজন-ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করে, তার নিত্য-নতুন স্ফূরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে । কিন্তু তার অবসান সেই সময়ে আরম্ভ হয় জখন তার নিজের স্ফূরণ-ক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তা-ই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে; তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন । অথাৎ তখন সমাজ-সংস্কৃতিটি হাংরি । আমার মনে হয়েছিল, দেশ-ভাগোত্তর বঙ্গসমাজ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মণীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয় ।
হাংরি আন্দোলন ছিল এই চিন্তাভাবনার ফসল । 'সম্প্রতি' পত্রিকায় ১৯৬২ সালে এই কথাগুলোই নিজের মতন করে শক্তিদা বলেছিলেন । প্রশ্ন হল যে পরে কোনো-কোনো আন্দোলনকারী হাংরি শব্দের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন । তা খুবই স্বাভাবিক । বাংলা সাহিত্যের প্রথম বাঁকবদলকারী আন্দোলন, যার খবর পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, এবং সব আলো আমার ওপর এসে পড়ছিল । তাই আন্দোলনের মধ্যেই প্রত্যেকে নিজস্ব পরিসর গড়তে চেয়েছেন । প্রচার চেয়েছেন ।
ডক্টর দে: হাংরি আন্দোলনের কবিরা যে ক্ষুধার কথা বলতে চেয়েছেন সেটা অনেক ক্ষেত্রে স্পষ্ট হয়ে ওঠে না । এতে আপনার অভিমত কি?
মলয়: একটু-আধটু পড়াশোনা না করলে বোধগম্য না হতেই পারে । অনেক পাঠকই লেখকের ক্ষুধা খুঁজে মরেন, যখন কি না ক্ষুধাটা ডিসকোর্সের ।
ডক্টর দে: হাংরিয়ালিজমের সঙ্গে ডাডাইজম এবং সুররিয়ালিজমের পার্থক্য কী ?
মলয়: ডাডাইজম ও সুররিয়ালিজম হল সময়-তাড়িত চিন্তাতন্ত্রের ফসল, জুডিও-ক্রিশ্চিয়ানিটির ফসল । হাংরিয়ালিজম হল পরিসরলব্ধ চিন্তাতন্ত্রের ফসল, বহুত্ববাদী ভাবনার ফসল । ডাডাইজম ও সুররিয়ালিজম লেখককে তার মস্তিষ্ক থেকে আলাদা করে ভেবেছে । হাংরিয়ালিজম লেখককে একলেকটিক বলে মেনে নিয়েছে । ডাডাবাদী-পরাবাস্তববাদীরা জন্মেছেন আর্ট ফর আর্ট সেক-এর পৃষ্ঠপটে, তাই ভাঙচুর করছেন । হাংরিয়ালিস্টরা 'আর্ট' কনসেপ্টটাকেই আক্রমণ করেছেন ।
ডক্টর দে: কোনো একটি কবিতা যে হাংরি সেটা বোঝার জন্য কোন বৈশিষ্ট্যগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে ? সাধারণ পাঠক কী করে বুঝবেন যে কবিতা-বিশেষটি হাংরি ?
মলয়: সাধারণ পাঠক কি আর কবিতা পড়েন ? মনে হয় না । পাঢবস্তুটি যদি সাহিত্যের তদানীন্তন উর্ধ ও নিম্ন সীমাগুলো লঙ্ঘন করে, তাহলে টের পাওয়া যেতে পারে । শৈলেশ্বর, প্রদীপ, ত্রিদিব, সুবিমল, দেবী, সুবো, ফালগুনী, উৎপল, সমীর, আমার ওই সময়ের কবিতা পড়ো । মুক্তসূচনা ও মুক্তসমাপ্তির কবিতা, বিষয়কেনদ্রহীন, শিরোনাম দিয়ে বিষয় চিহ্ণিত হয় না, শব্দের ও ছন্দের যথেচ্ছাচার, লজিকাল সিকোয়েন্স বর্জিত, গুরুচণ্ডালি ভাষা, ইন্দ্রিয় পালটা-পালটি, প্রতীক বর্জিত, ছেঁড়া চিত্রকল্প ইত্যাদি । অথাৎ পাঠবস্তুটি বিবেচ্য, লেখক নন ।
ডক্টর দে: এমন অনেক কবিতা হাংরি-পরবর্তী কালে রচিত হয়েছে যেগুলোর মধ্যে যৌন শব্দ, অশ্লীল শব্দ, নতুন শব্দ, নিম্নশ্রেণির শব্দ, অশ্লীল উপাদান, ঘৃণ্য জীবনবোধ ইত্যাদি পাওয়া যায় । সে-ধরণের কবিতাকে কী হাংরি প্রভাবিত কবিতার পর্যায়ে ফেলা যায় ? অথবা অনেকেই হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, হাংরি আন্দোলন সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, কিন্তু দেখা যায় হাংরি কবিতার বৈশিষ্ট্য তাঁদের লেখায় রয়েছে । সেগুলোকে কি হাংরি কবিতা বলব না ?
মলয় : হাংরি আন্দোলনের সময় কাল ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ । ফলে স্বাভাবিক যে তার পরের অনেক কবি প্রভাবিত হবেন । আগের প্রশ্নের উত্তরে যে বৈশিঢ়্ট্যের কথা বললুম সেগুলো যদি থাকে তো অস্বিকার করার কারণ দেখি না । উত্তরবঙ্গ আর ত্রিপুরার আনেকে নকশাল আন্দোলনের পর নিজেদের হাংরি ঘোষণা করেছেন । আমি তাঁদের চিনি না, দেখিনি । এটাই তো হাংরির সাফল্য ।
ডক্টর দে: আপনি ১৯৬৫ সালে পালামৌতে সম্বর্ধনায় লেখা ইংরেজি বক্তৃতায় বলেছিলেন, "আমি কবিতাকে জীবনে ফিরিয়ে দিতে চাই" । পেরেছেন কি ?
মলয়: না, পারিনি মনে হয় । বঙ্গসমাজ সম্পূর্ণ বদলে গেছে, কবিতাহীন হয়ে গেছে । বাজার হয়ে উঠেছে প্রধান ডিসকোর্স । ফলে কবিতা প্রক্রিয়াটাই আজ কাউন্টার-ডিসকোর্সের চেহারা নিতে বাধ্য হয়েছে । কবিরা যেন গোপন সমিতির সদস্য । তার বাইরে বেরোলেই ঢুকতে হবে বাজারা । এখন কবিরাই শুধু কবিতা পড়ে । সে-সময়ে রাজনীতিকরাও কবিতা পড়তেন ।
ডক্টর দে: সমস্ত লেখকই লেখার শুরুতে প্রতিষ্ঠান আঁকড়ে ধরতে চান । তার কারণ প্রচারমুখিতা ।ঔ যে যত প্রচারিত সে তত সার্থক বলে মনে করা হয় । তাহ।এ প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা করা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব না-পাওয়াই বোঝায় । আপনি কি বলেন ?
মলয়: এসটাবলিশমেন্ট ও অ্যান্টিএসটাবলিশমেন্ট শব্দদুটো বঙ্গসমাজে আমিই প্রথম এনেছিলুম । দুর্ভাগ্যবশত ক্ষমতালোভী বামপন্হীরা শব্দ দুটোর সঙ্গে আনন্দবাজারকে গুলিয়ে দিয়েছিল । মনে রাখতে হবে যে আমরা নাড়া দিতে চেয়েছিলুম প্রশাসনকে, যে অক্টোপাসের একটা আঁকশি ছিল আনন্দবাজার । এখন অন্য আঁকশিগুলোকে গণশক্তি, বাংলা আকাদেমি, তথ্যসংস্কৃতি বিভাগ, নন্দন, আলিমুদ্দিন, মহল্লা কমিটি, পঞ্চায়েত ইত্যাদি দিয়ে সহজে চিহ্ণিত করা যায় । এখন এসটাবলিশমেন্ট আরও ভয়ংকর । তার চাই লাশের পর লাশ ।
রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠান শব্দটার বদলে অচলায়তনের কথা বলেছিলেন । আমাকে নিয়ে মুর্শিদ এ. এম. যে-বইটা প্রকাশ করেছেন, তাতে কলিম খান তাঁর রচনায় গৌতম বুদ্জধ, শংকরাচার্য, রবীন্দ্রনাধ প্রমুখকে বলেছেল প্রতিষ্ঠানবিরোধী ।
যাঁরা লেখালিখির ব্যবসায় ঢুকতে চান তাঁদের জন্যে আনন্দবাজার জরুরি । যাঁরা সরকারি পুরস্কারের জন্যে লালায়িত তাঁরা গণশক্তি পত্রিকায় ঢুকতে চান । প্রচারিত হন তাঁরা । কিন্তু বেশিরভাগই হারিয়ে যান । সকলে ওসব জায়গায় ঢুকতে চায় না, কেউ-কেউ চায় । প্রধানত অন্য ভালো চাকরি জোটা না বলে । তাছাড়া প্রচারের আলোয় থাকার জন্যে অবিরাম লেখা-ব্যাপারটার ঘানি ঘোরাতে হয় । প্রতিষ্ঠান য়ভক্তি-এককের মূল্যবোধ নষ্জট করে । অক্টোপাস তাকে যে আঁকশি দিয়েই আঁকড়ে ধরুক না কেন ।
ডক্টর দে: আমরা জানি হাংরি আন্দোলন যাঁরা শুরু করেছিলেন তাঁরা প্রথম থেকেই প্রতিষ্ঠানবিরোধী । এমন কি, প্রতিষ্ঠানের পত্রিকাব যাঁরা লিখতেন তাঁদেরও কয়েকজন হাংরি আন্দোলনকে সমর্থন করে বুলেটিনগুলোয় লিখতেন । তাহলে স্বীকার করতে হয় এই আন্দোলোনটাই একটা প্রতিষ্ঠান । আপনি স্বীকার করেন কী ?
মলয়: অক্টোপাসের কোনো আঁকশির ক্ষমতাই হাংরি আন্দোলনের ছিল না । শক্তিকে আনন্দবাজারের আঁকশি ধরেছিল, উৎপলকুমার বসুকে এখন ধরেছে । সুভাষ আর বাসুদেবকে ধরেছিল সিপিএমের আঁকশি । সুবিমল সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার নিয়েছে । তাতে হাংরি আন্দোলনের স্ট্রাকচার এবং কাউন্টারডিসকোর্সে রদবদল হয় না । সুররিয়ালিজম আন্দোলন থেকেও অনেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন । আর কীর্তি হিসেবে উৎপলের 'পুরী সিরিজ' ও শক্তিদার 'হে প্রেম হে নৈঃশব্দ' এবং বাসুদেব দাশগুপ্তের 'রন্ধনশালা' তাতে ক্ষুন্ন বা বাতিল হয় না । সাহিত্যিক কাজ য়্যাপারটা প্রতিষ্ঠানের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে না । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এখন প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড়ো ব্যবসায়ী বটে --- আনন্দবাজার ও সিপিএম দুটিতেই--- এবং আমি তাঁর সমালোচনা করি । কিন্তু কৈশোরকালীন সম্পর্কের দরুন তাঙকে শ্রদ্ধা করি । ওই সম্পর্কের কারণে উনি আমার পক্ষের সাক্ষী ছিলেন; যখন কি না শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ দিয়েছিলেন ।
ডক্টর দে: আধুনিকতা ব্যাপারটা আপনার মতে "একখানি ধ্রুপদী জোচ্চোর" । কী ভাবে ?
মলয় : 'মেধার বাতানুকুল ঘুঙুর 'গ্রন্হে 'ধ্রুপদী জোচ্চোর' শিরোনামে আমার কবিতাটা পড়েছ কি ? 'কবিতা পাক্ষিক' থেকে 'আধুনিকতার বিরুদ্ধে কথাবাত্রা' নামে আমার একটা বই বেরিয়েছিল । ওদের ওয়েবসাইটে দেখলুম এখনও পাওয়া যায় । মডার্ন, মডার্নিটি, মডার্নিজম কিন্তু একই ব্যাপার নয় ।
বঙ্গীয় আধুনিকতা প্রসারিত হয়েছিল ঔপনিবেশিকতার স্ফূরণরূপে । স্বাভাবিক যে উত্তর-ঔপনিবেশিকতায় তার আদল-আদরা পালটাবে । ইউরোপে ঠিক যে-ভাবে ও যে-কারনে আধুনিকতার উদ্ধব ও প্রসার ঘটেছিল, আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে সে-ভাবে ও সে-কারণে তা ঘটেনি । আমাদের অভিধানে তাই আধুনিকতার অর্থ বর্তমানকালীন, সাম্প্রতিক, হালের, অধুনাতন, নব্য । আসলে, আধুনিকতা হল জীবনের একটি ফর্ম, পরিবর্তিত মূল্যবোধ, বিশ্বাস, আচার-আচরণ, সামাজিক বিন্যাসের কাঠামো । অন্যরকম আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ, আদান-প্রদানের জীবন উদ্ভূত হয়েছিল, এবং হোতারা তাকে ইতিবাচকতা দিয়েছিলেন ।
জ্ঞান ব্যাপারটা অটীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল ওই জীবনবোধে, যা থেকে বিশেষজ্ঞদের আবি্র্ভাব । বিজ্ঞানের এক বিশেষ দৃষ্টি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল জ্ঞান সম্পর্কে অমন ধারণা । এখন তাকে বলা হচ্ছে রিডাকশানিজম বা খণ্ডবাদ । অমন জ্ঞান না থাকাকে আধুনিকতা মনে করেছে মূর্খতা, অর্থাৎ তা খারাপ, অনৈতিক, অজ্ঞতা, আনকালচার্ড । আধুনিক বিজ্ঞানকে তুলে ধরা হয়েছিল একটি সর্বজনীন, মূল্যবোধ-নিরপেক্ষ জ্ঞান-কাঠামো হিসেবে, এবং মেনে নেয়া হয়েছিলযে ব্রহ্মাণ্ড, জীবন ও সমস্ত কিছু সম্পর্কে তা শেঢ় কথা বলে দিতে পারে । এই যান্ত্রিক প্যারাডাইম বা খণ্ডবাদকে ইউরোপ প্রয়োগ করেছিল সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে; নিজেদের আধিপত্যকে বৈধতা দেবার স্বার্থে । সাম্রাজ্যবাদ, খণ্ডবাদ, আধুনিকতাবাদ, বিজ্ঞানবাদ সবই চলেছে হাতে হাত মিলিয়ে ।
ওই ইউরোপীয় প্যারাডাইমটার জ্ঞানতাত্বিক, এমনকি তত্ববাদী অনুমানগুলো, সমরূপতা বা একরূপতার ধারণার ওপর নি্র্যরশীল, যা মনে করে যে, তাবৎ নিয়ম, ব্যবস্হা, প্রণালী, কাঠামো ইত্যাদির বুনিয়াদি উপকরণগুলোর মধ্যে পার্থক্য নেই । আধুনিক কবিতার প্রতিপাদকরা এই খণ্ডবাদী দর্শনের পথটিকে সমস্ত কবিদের ক্ষেত্রে অবশ্যমান্য করতে চেয়েছে, বেঁধে দিতে চেয়েছে সমরূপতার অনুশাসন, ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী শর্ত অনুযায়ী । জোচ্চুরি ছাড়া আধিপত্য হয় না । তুমি ভেবে দেখো, কেন বহুকাল পর্যন্ত নজরুল আর জসীমুদ্দিনকে একঘরে করে রেখেছিলেন ওই হোতারা । ভাগ্যিস নজরুল মারা গেলেন বাংলাদেশে ।
খণ্ডবাদের অধিযান্ত্রিক উপমাগুলো প্রকৃতি ও সমাজকে, সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক স্তরে পুনর্গঠন করেছে নিজেদের স্বার্থে । প্রকৃতির ওপর আরোপ করা হয়েছে যান্ত্রিকতার মেটাফর, যেহেতু তা বিভাজন-সহায়ক এবং স্বকার্যে প্রয়োগযোগ্যতার অনুমানে ভর করে দাঁড়ায় । পক্ষান্তরে, জৈব মেটাফরগুলো মনে করেছে যে পরস্পর-নির্ভরশীলতা এবং আদান-প্রদানের দ্বারা ক্ষমতার বিন্যাস হোয়া দরকার । বাস্তবজগত একটি জীবন্ত ব্যাপার । এই জীবন্ত ব্যাপারটিকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে খণ্ডবাদ থেকে চাগিয়েছে আর প্রশ্রয় পেয়েছে সন্ত্রাস । বহু আদর্শকে আধুনিকতা মানবসমাজে এনেছিল, এবং সেগুলোকে প্রতিষ্ঠা দেবার প্রধান উপায় করা হয়েছে সন্ত্রাসকে ।
ডক্টর দে: দীর্ঘদিন লেখা থেকে বিরতি ঘটিয়ে যখন দ্বিতীয়বার লেখারজগতে ফিরে এলেন, তখন আপনি বলেছিলেন, নিজেকে ক্ষুধার্ত মনে করি না । কেন? ক্ষুধার্ত প্রজন্মের স্রষ্টা আপনি । তার মানে ক্ষুধা শেষ ? যখন আন্দোলন করেছিলেন, তখনও কি ক্ষুধা ছিল না? কিন্তু অনেকেরি যে ক্ষুধা ছিল এবং রয়েছে ?
মলয়: তুমি আবার পেটের খিদের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনকে গুলিয়ে ফেলছ । আমলাশোল আর ডুয়ার্সে চাষি আর মজুররা না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে বলে সরকারের তুলোধুনা করব । নিজেকে ক্ষুধার্ত বলতে যাব কেন? হাংরি আন্দোলন থেকে বেরিয়ে যারা সিপিএমের ছত্রছায়ায় ঢুকেছিল---যেমন সুভাষ, বাসুদেব, শৈলেশ্বর--- তারাই এই গোলমালটা বাধিয়েছে । দিব্বি চাকরি-বাকরি করে আরামে থেকেছে আর নিজেদের বলেছে সর্বহারা ।
নিজেকে সেই সময়ে হাংরি আন্দোলনকারী বলতুম, ক্ষুধার্ত বলতুম না । তাছাড়া, নিজেকে ক্ষুধার্ত মনে না করার বহুবিধ কারণ আছে । যেমন, যাঁরা মুচলেকা দিয়ে রাজসাক্ষী হলেন (সুভাষ ও শৈলেশ্বর), তারাই 'ক্ষুধার্ত' নামে পত্রিকা বের করতেন । তাঁদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, পড়াশোনা, মূল্যবোধের সঙ্গে আমার কোনো মিল নেই । অনুপম মুখোপাধ্যায়ের রিভিউ পড়ে জানতে পারলুম, আমার নামে তাতে জাল প্রবন্ধও ছাপা হয়েছে ।
যাঁরা নিজেদের ক্ষুধার্ত বললেন তাঁরা শাসকদল ও তার শিক্ষক সংগঠনে ঢুকলেন । হাংরি আন্দোলনকারীর তো অচলায়তন ভাঙার কথা । তারা তাতে ঢুকে আশ্রয় নেবে কেন? এটা তো জোচ্চুরি । আত্মসন্মানবোধহীনতা ।
উত্তরবঙ্গ আর ত্রিপুরায় অনেকে ক্ষুধার্ত ঘোষণা করেছিলেন নিজেদের । দেখলুম তাঁদের চেয়ে আমি সব ব্যাপারেই আলাদা । অভিজ্মতা ও ভাবনাচিন্তায় তো বটেই । আবার যখন লিখতে আরম্ভ করলুম তখন চাকুরিসূত্রে সারা ভারতবর্ষ চষে বেড়াচ্ছি, বিশেষ করে গ্রামে-গ্রামে ।
ডক্টর দে: শিল্পকৃতির জন্যে আন্দোলন জরুরি নয়; শিল্পী ও ভাবুকদের মধ্যে অনেকেই নির্জনে সাধনা করার পক্ষপাতি ল কথাটা আপনি কতটুকু সমর্থন করেন ?
মলয়: মন্দিরের আরাধ্যরা শিল্পকৃতি নন । তাঁদের উপড়ে চুরি করে ইউরোপ-আমেরিকায় কোটি-কোটি ডলারে বিক্রির পর তাঁরা হয়ে যান শিল্পবস্তু । অর্থাৎ তা থেকে ডিভিনিটি নিষ্কাশিত । শিল্প শব্দটা হল আর্ট শব্দের বাংলা, যে কনসেপ্ট এসেছে সাম্রাজ্যবাদের কাঁধে চেপে ।
কবিতা, উপন্যাস লেখার জন্যে আন্দোলন জরুরি নয়, এটা ঠিক । সে-সময়ে কাউন্টার কালচারাল মুক্তধারা বইয়ে দেবার জন্যে প্যারাডাইম শিফ্ট দরকার ছিল ।
আর নির্জনে একা বা অনেকের মাঝে বসে যারা কখনও সাধনা ব্যাপারটা কী, তা জানার চেষ্টা করেননি, তাঁরা অমন মধ্যযুগীয় অভিব্যক্তি প্রয়োগ করতেন । আমি আচার্য রজনীস (তখন তিনি চন্দ্রমোহন জৈন ছিলেন), রামকৃষ্ণ আশ্রম, বালটিবাবা, মোহন্ত গোরখনাথ, গাঁজাপায়ী নিরক্ষর সন্ন্যাসী, সব সঙ্গ করে দেখে নিয়েছি । লেখা।লিখির জন্যে দরকার বিপুল অভিজ্ঞতা । জীবনানন্দ রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরতেন । রবীন্দ্রনাথ হিল্লি-দিলই করতেন । নানা এলাকার নানা রকম মানুষের সঠ্গে যত বেশি মেশা যায়, একজন লেখক ও ভাবুক তত বেশি সমৃদ্ধ হন । নির্জনে নয় ।
ডক্টর দে: হাংরি আন্দোলন শুরু করার আগে বাংলা-সাহিত্যের কোন কবি-লেখকদের রচনা পড়েছিলেন ? মন্বন্তর,দেশভাগ, উদ্বাস্তু, দাঙ্গা, এগুলো হাংরি আনদোলনের ক্ষেত্রে আপনার চিন্তায় কতটুকু প্রভাব ফেলেছিল ?
মলয়: আমি ভালো পড়ুয়া ছাত্র ছিলুম । বাবাকে আর দাদা সমীরকে বললেই বই কেনা যেত । চাকরি করতে ঢুকে বাড়ির জন্যে খরচ করতে হত না । বই কিনতুম আর অভিজ্ঞতা সংগ্রহে খরচ করতুম । তাই রবীন্দ্রনাথ আর শশধর দত্ত আকযোগে পড়েছি । গোগ্রাস পাঠক ছিলুম । বন্ধু-বান্ধব, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, দাদা ও দাদার কবি-বন্ধুদের মুখে নাম শুনলেই বই যোগাড় করতুম ।
বই পড়ে বা লোকমুখে শুনে যে চিন্তা-প্রক্রিয়া গড়ে ওঠে তার তুলনায় আভিজ্ঞতা-সঞ্জাত চিন্তা-প্রক্রিয়াকে আমি গুরুত্ব দিই । অভিজ্ঞতার বাইরে গিয়ে লিখলে তার লিটেরারি প্রেমাইস থাকে না । ছোটোলোকের ছোটবেলা, এই অধম ওই অধম, অভিমুখের উপজীব্য, ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস, জলাঞ্জলি, নামগন্ধ, নখদন্ত বইগুলো পড়লে তুমি তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে ।
ডক্টর দে: একজন লেখক, কবি বা চিত্রকর যে হাংরি আন্দোলনের সহযোদ্ধা তা কী করে বোঝা যাবে ?
মলয়: সহযোদ্ধা কথাটায় আমার আপত্তি আছে । ওটা যুদ্ধ ছিল না । বলতে হবে অংশগ্রহণকারী ।
ম্যানিফেস্টোগুলোয় যাঁদের নাম আছে, কোনো না কোনো সময়ে, তাঁরা অঙশগ্রহণকারী ।
হাংরি আন্দোলনের কোনো হেডকোয়ার্টার, পলিটব্যুরো বা হাইকমাণ্ড ছিল না । তাই যিনি চেয়েছেন তিনিই নিজেকে অঙশগ্রহণকারী ঘোষণা করেছেন । যেমন অরুণেশ ঘোষ, অলোক গোস্বামী, রাজা সরকার, সেলিম মুস্তফা, রসরাজ নাথ, বিকাশ সরকার, অরুণ বণিক, জীবতোষ দাস, আপ্পা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ নিজেদের হাংরি ঘোষণা করেছিলেন, আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার দেড়-দুই দশক পর । ফলে ইমপ্যাক্ট প্রমাণিত ।
ডক্টর দে: শক্তি চট্টোপাধ্যায় এই আন্দোলনকে বলেছিলেন সর্বগ্রাসী ? কেমন করে ?
মলয়: একটু আগেই তো স্পেংলার ব্যাখ্যা করার সময়ে সে-কথা বললুম ।
ডক্টর দে: দেবেশ রায় বলেছিলেন, "তত্ববিশ্বের ক্ষেত্রে হাংরি আন্দোলন ছিল নকশাল আন্দোলনের প্রথম ধাপ"। আপনার মন্তব্য কী?
মলয়: উনি সরকারি মার্কসবাদী বলেই হয়ত নেতিবাচক দৃষ্টিতে কথাটা বলে থাকবেন । কিউবায় কারোর ফুসকুড়ি হলে ওনারা মিছিল-মিটিং করতেন । আমার পুলিশি হেনস্হার সময়ে এগি্যে আসেননি । মার্কসবাদীদের মধ্যে একমাত্র তরুণ সান্যাল এসেছিলেন, পার্টির দাদাদের নিষেধ সত্বেও । আর যুগান্তর সংবাদপত্রে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন কৃষ্ণ ধর ।
ডক্টর দে: "বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার জটিলতা ও আস্পষ্টতার বিরুদ্ধে হাংরি আন্দোলনই ছিল প্রথম পরিকল্পিত বিদ্রোহ" । আধুনিকতার জটিলতা ও অস্পষ্টতা প্রাঞ্জল করে দিলে পাঠকের সামনে ধোঁয়াটে ভাব কেটে যাবে ।
মলয়: আধুনিকতা সম্পর্কে ব্যাপারটাতো একটু আগেই ব্যাখ্যা করেছি । আর হাংরি আন্দোলন যে পরিকল্পনা করেই আমি দাদা, শক্তিদা করেছিলুম তা আজ সবাই জানেন ।
ডক্টর দে: ব্যক্তিগতভাবে হাংরি আন্দোলন নিয়ে সে-সময়ে বিদেশি কাদের সঙ্গে আলোচনা হত ? আজকের দিনে হাংরি আন্দোলন বিষয়ে বিদেশিরা এখনও আলোচনা করেন কি।
মলয়:আলোচনা ধরণের তেমন কিছু হত না । তবে, আন্দোলন আরম্ভ হবার পর দেখা-সাক্ষাৎ ঘটেছে হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড,অ্যালেন গিন্সবার্গ, জর্জ ডাউডেন, ওকতাভিও পাজ, ডেইজি অ্যালডান, আরনেস্তো কার্দেনাল প্রমুখের সঙ্গে । বহু লেখক-কবি-সম্পাদকের সঙ্গে যোপগাযোগ ছিল, যাঁরা ম্যানিফেস্টো, কবিতা ইত্যাদি প্রকাশ করেছিলেন, যেমন লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, ডিক বাকেন, মার্গারেট র্যানডাল, এরিক মটর্যাম, জেরোম রোদেনবার্গ, বার্নে রসেট, ক্যারল বার্জ, কার্ল ওয়েসনার, রবার্ট কেলি, গর্ডন ল্যাসলেট, ড্যান জর্জাকাস, আইডা স্পলডিং, লেরয় জোন্স (হামিরি বারাকা), অ্যালান ডি লোচ, অ্যালেন ভ্যান নিউকার্ক, জেমস লাফলিন, ডায়না ডি প্রিমা, জর্জ বাওয়ারিং, পল ব্ল্যাকবার্ন, অ্যালেন হফম্যান, ক্লেটন অ্যাশলেম্যান, ক্যারল রুবেনস্টিন, অ্যার্মন্ড শোয়েনার, টেড বেরিগ্যান, রবের্তো হুয়ারোজ, লিটা হরনিক প্রমুখ । বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ওনাদের আরকাইভে আমার চিঠি-কবিতা-ম্যানিফেস্টো যে সংরক্ষিত তা 'গুগল' সার্চ করলে পাওয়া যায় ।
হাইকোর্টে মকদ্দমার অকল্পনীয় খরচ মেটাতে অনেকে লেখা ছাপিয়ে সাহায্য করতেন । এখানে কমলকুমার মজুমদার এবং অশোক মিত্র আই এ এস ছাড়া কেউ সাহায্য করেননি । কলকাতায় থাকার জায়গাও ছিল না ।
হাংরিয়ালিজম বা আন্দোলনকারীর নামে নেট সার্চ করলে বোঝা যায় যে অবিরাম আলোচনা-মন্তব্য চলছে । বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ভাষায় ।
ওই সময়ে বেনারস-পাটনা-নেপালে বহু হিপি-হিপিনীদের সঙ্গেও সময় কাটিয়েছি, যাঁরা নেশা-যৌনতার যথেচ্ছচারী জীবন কাটাতে ইউরোপ,আমেরিকা, জাপান থেকে আসতেন । ওই সময়ের এক ঝলক আমি ব্যবহার করছি "অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা" উপন্যাসে ।
ডক্টর দে: কোন ধরণের কবিতা অমরত্ব পায় ? অর্থাৎ মৃত্যুর পর শত বছর পরও কোনো-কোনো কবিতা আমরা আবার পড়ি । কেন?
মলয়: অমরত্ব ব্যাপারটা বলতে পারব না । বহু কবিতা অ্যাকাডেমিক চত্বরে পঠিত হব, অথচ জনমানস থেকে লোপাট হয়ে যায় । যেমন চর্যাপদ, শূন্যপুরাণ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, পদাবলী সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, দৌলত কাজী-সৈয়দ আলাওল, মৈমনসিংহগীতিকা, ভারতচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন, সবাই অমর । কিন্তু কলেজের বাইরে কেউ পড়ে না।
ডক্টর দে: আমরা কবিতায় 'আধুনিক' শব্দটা প্রয়োগ করি । আসলে 'আধুনিক' শব্দটা কবিতার বেলায় কতটুকু প্রযোজ্য ? কবিতার আধুনিকতা প্রকৃতপক্ষে কী?
মলয়: একট আগেই এ-বিষয়ে অনেক কথা বলেছিলুম । বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ হলেন সাহিত্যের জলবিভাজক । তাঁর পূর্বের কবিদের পড়লে আমরা বুঝতে পারি লেখাগুলো প্রাগাধুনিক । তাঁর পরের কবিদের লেখা পড়ে বুঝি যে তা আধুনিক । অতএব শব্দটা যে প্রযোজ্য সে-ব্যাপারে সংশয় থাকা নিরর্থক ।
"বদ্ধসূচনা ও বদ্ধসমাপ্তির মাঝে একটি স্বয়ংসম্পূর্ন ভাষা পরিসর যা একরৈখিক অন্তর্বয়নের মাধ্যমে যুক্তিক্রম মেনে নির্মিত, এবং যার বিষয় কেন্দ্রের মালিকানা কবির নিজস্ব, এবং শিরোনামের দ্বারা তিনি তা ঘোষণা করেন, অবশ্যই গৃহপালিত বাকমণ্ডল ব্যবহার করে"। আধুনিক কবিতার এরকম একটা সংজ্ঞা হতে পারে । আর্চিবল্ড ম্যাকলিশ আধুনিক কবিতা সম্পর্কে বলেছিলেন, "ইট শুড নট মিন, বাট বি" । দীপ্তি ত্রিপাঠী আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য বলার সময়ে যে পয়েন্টগুলো দিয়েছিলেন সেগুলো উত্তরআধুনিক কবিতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য । ওনার সময়ে উত্তরআধুনিক বা পোস্টমডার্ন ব্যাপারটা আসেনি বলে ওনার বক্তব্য থেকে আমরা বঞ্চিত ।
ডক্টর দে: কোন-কোন উপাদানের সাহায্যে বোঝা যাবে যে একটি কবিতা উত্তরআধুনিক?
মলয়: দাদা সমীর রায়চৌধুরী উত্তরঔপনিবেশিক বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষিতে আধুনিক এবং উত্তরআধুনিক কবিতার তুলনামূলক তালিকা তৈরি করেছিলেন। সেটা দেখেও, তাহলে দুটোই স্পষ্ট হবে । সমীর চৌধুরী নামে এক ভদ্রলোক, যিনি "আংরি জেনারেশান রচনা সংকলন" বের করেছেন, তাঁর সঢ্গে আমার দাদাকে গুলিয়ে ফেলো না যেন।
ডক্টর দে: অভিযোগমত হাংরি কবিতা যদি অশ্লীল হয়, তাহলে রামায়ণ, মহাভারত, গীতগোবিন্দ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মনসামঙ্গল অশ্লীল । কোনারক, খাজুরাহো, পুরীর মন্দির অশ্লীল । সাহিত্য-শিল্পে শ্লীল-অশ্লীল ভেদাভেদ নিয়ে আপনার বক্তব্য চাইব । অশ্লীলতা বিষয়ক হাংরি বুলেটিনে যা বলা হবেছিল, তাছাড়া আর কোনো বক্তব্য আছে কি?
মলয়: সনাতন ভারতবর্ষে শ্লীল-অশ্লীল ভেদাভেদ যে ছিল না, তা তোমার উল্লেখ করা কাজগুলো থেকেই স্পষ্ট । সনাতন ভারতবর্ষে দেখা হত কাজটা রসশাস্ত্র-অলঙ্কারশাস্ত্র অনুযায়ী হয়েছে কিনা । শৃঙ্গার-রস ব্যাপারটাই তো আদি রস ।
দুর্ভাগ্যবশত আরবি-তুর্কি-আফগানি বিটকেল মূল্যবোধের প্রথম ঝাপটায় সনাতন ভারত ব্যাপারটা লোপাট হয়ে গেল । প্রচুর ভাঙচুর হল । তারপর এল ভিকটোরীয় খ্রিষ্টধর্মীর দল । যেটুকু বেঁচেছিল তা-ও গেল । ওরা অবসিনিটির আইন র্বিটেন থেকে আমদানি করে কী শ্লীল আর কী অশ্লীল তার র্খিষ্টিয় ফতোয়া দিতে লাগল । ওদের আনা মানদণ্ডের চাকর হয়ে গেল ভারতীয়রা । এত পুরু ঔপনিবেশিকতার চাদর জমে গেছে এদেশের চিন্তা-চেতনায় যে তা সহজে যাবার নয় । তার ওপর, সমাজে যারা ছড়ি ঘোরায়, তারা ইংরেজদের আদল-আদরায় নিজেদের সংস্কৃতিমান মনে করে । এঁরাই হাংরি আন্দোলনে অশ্লীলতা খুঁজে বের করেছিলেন ।
ডক্টর দে: যৌনতা ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত । মানুষের যৌনক্ষুধা বিলুপ্ত হয়ে গেলে অনেকটা জড়পদার্থে পরিণত হয়ে যায় । যৌনতা মস্তিষ্কগত, যে-কারনে পশুদের মত মানুষের যৌনতার ঋতু হয় না । বিজ্ঞানমতে যার যৌনশক্তি যত প্রখর, তার তত মেধার জোর, এবং সৃষ্টিশক্তি । তাহলে কাব্য-সাহিত্যে এর প্রকাশকে যাঁরা অপরাধ বলেন, তাঁরা কি ঠিক করেন?
মলয়: তারা সব বাঁজা বা হিজড়ে ।
ডক্টর দে: যারা রাজনৈতিক উগ্রপন্হী, তারা বিভিন্নভাবে মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে । আমরা শুনেছি, হাংরি আন্দোলনকারীরা ইশতাহার বুলেটিন পোস্টার হ্যান্ডবিল পত্রপত্রিকা বই ইত্যাদি প্রকাশের বাইরে কিছু আতঙ্ক সৃষ্টিকারী কার্যকলাপ করেছিলেন । যেমন, সম্পাদককে জুতোর বাক্স দিয়ে বলা হয়েছিল রিভিউ করতে; টপলেস যুবতীর প্রদর্শনী, সাদা কাগজ গল্প-সম্পাদককে দিয়ে বলা হয়েছিল ছাপাতে । বিয়ের কার্ডে কবিতা পাঠের নিমন্ত্রণপত্র তৈরি করা হয়েছিল । "মুখোশ খুলে ফেলুন" লেখা রাক্ষস, ও পশুর মুখোশ মন্ত্রীদের পাঠানো, মাইকেলের সমাধিতে-খালাসিটোলা-কেওড়াতলা শ্ঞশানে কবিতা পাঠের আয়োজন, বাঁকুড়ায় উলঙ্গ অবস্হায় নদী পারাপার, দুমকায় হাড়িয়ার হাঁড়ি বাজিয়ে দোলের সময় উদ্দাম নৃত্য, হিপিনীদের সঙ্গে নেশা ও যৌনতার বেনারসী-নেপালি অনাচার, গ্রন্হের দাম ১৪৪৩৫০০ টাকা রাখা বা ৫০টি টিয়ি সিল রাখা ইত্যাদি । এখন কথা হচ্ছে, হাংরি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল সাহিত্যশিল্পে স্হিতাবস্হা ভাঙা । তা করতে গিয়ে এই সমস্ত কার্যকলাপ কেন? হাংরি আন্দোলনকারীদের এই কার্যকলাপের সঙ্গে ডাডা আন্দোলনকারী এবং বিট জেনারেশানের কার্যকলাপের মিল খুঁজে পান আলোচকরা । তা কতটা সত্য? আমার মনে হয়, কেবল সাহিত্যশিল্প চর্চায় নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখলে, হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা-মকদ্দমা-হেনস্হা হত না । অশ্লীলতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দ্রোহের অভিযোগে গ্রেপতার হতেন না । তখনকার সাহিত্যিক, রাজনেতা, প্রশাসক, সাংবাদিক, বণিকরা এবং সমাজের গণ্যমান্যরা বাধ্য হয়ে প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন যাতে হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা-মকদ্দমা হয়, এবং কোর্টে ডাকাত ও খুনিদের পাশাপাশি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে অপমান ও কারারুদ্ধ করা হয় । অনেক ক্ষেত্রে আপনাদের এই কার্যকলাপকে বয়স্ক শরিকরা, যাঁরা কৃত্তিবাস গোষ্ঠী ছেড়ে হাংরি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, অন্তর দিয়ে সমর্থন করেননি, যতটা করেছিলেন সাহিত্যে সহিতাবস্হা ভাঙার আন্দোলনকে । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, ওগুলো সস্তায় নাম কেনার চেষ্টা । এই সমস্ত অভিযোগ সম্বন্ধে কী বলবেন ?
মলয়: ডাডা আন্দোলনের ত্রস্তান জারা, মিশেল দুশঁ প্রমুখের প্রয়াস ছিল যুদ্ধোত্তর ইউরোপে শিল্পকৃতিকে রিডিফাইন করার প্রয়াস । অ্যালেন গিন্সবার্গ, উইলিয়াম বারোজ, জ্যাক কেরুয়াক প্রমুখ বিট আন্দোলনকারীরা ম্যাককার্থি-পরবর্তী রক্ষণশীল আমেরিকার দমবন্ধকরা আবহাওয়া কাটিয়ে খোলা হাওয়া আনতে চাইছিলেন । আমাদের কার্যকলাপ ছিল দেশভাগোত্তর বিপর্যয়ে আক্রান্ত উত্তরঔপনিবেশিক বঙ্গসমাজের স্হিতাবস্হায় আঘাত দেয়া । অচলায়তনে ফাটল ধরিয়ে মুক্তধারাকে বের করা । কাগজ কলম নিয়ে ঘরে বসে তিনে কত্তে তিন হাতে রইল পেনসিল নয় ।
হামাকে হাতকড়া পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে ডাকাতদের সঙ্গে রাস্তায় হাঁটানো হল । প্রদীপ চৌধুরী শান্তিনিকেতন থেকে রাস্টিকেট হল । উৎপলকুমার বসু যোগমায়া দেবী কলেজের অধ্যাপকের চাকরি থেকে বরখাস্ত হলেন । আমার দাদা সমীর রায়চৌধুরী চাকরি থেকে সাসপেন্ড হলেন । সুবিমল বসাক আর দেবী রায়কে কলকাতার বাইরে বদলি করে দেয়া হল । কফিহাউসের সামনে লোহার রড, চেন, হকিস্টিক নিয়ে সুবিমলকে ঘিরে ফেলা হল । এগুলো থেকেই তো প্রমাণ হয় যে স্হিতাবস্হায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছিল ।
ওসব কার্যকলাপে কেউ আতঙ্কিত হয়েছিল বলে তো শুনিনি । ভিরমি খেয়েছিল বা ঘাবড়ে গিয়েছিল বলা যায় । তখন পর্যন্ত বঙ্গীয় সাহিত্যিকরা ছিল "আর্ট ফর আর্ট সেক"-এর নৌকোয়, যা হাংরি আন্দোলনের ধাক্কায় ডুবে যায় । বঙ্গসমাজের পচনকে যে হাংরি আন্দোলনকারীরাই শনাক্ত করেছিল, বামপন্হীরা নয়, তা এখনকার পশ্চিম বাংলার দিকে তাকালেই টের পাবে ।
আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বহু ধান্দবাজি করে নাম কিনেছেন, এ-ব্যাপারে কিছু বললে বড় মুখে ছোট কথা হয়ে যাবে । ওনার গুণগ্রাহী বিশ্বব্যাপী । শক্তি চট্টোপাধ্যাব আনন্দবাজার চাকরি পাবেন বলে উষ্মা প্রকাশ করেন । শৈলেশ্বর আর সুভাষ যে মুচলেকা দিয়েছিল তা বহু লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে ।
ডক্টর দে: আজকের এই সময়ে দাঁড়িয়ে যদি হাংরি আন্দোলন শুরুর কথা ভাবা হয়, তাহলে কীভাবে ভাববেন ? দর্শন ধার করার জন্য স্পেঢলারের 'দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট' বইটির প্রয়োজন হবে কি ? নতুন দর্শন যুক্ত করার প্রয়োজন থাকলে কার দর্শন গ্রহনযোগ্য মনে করেন? প্রথম ইশতাহার শুরু করলে আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আপনার অভিমত কী হবে ? ধরা যাক, প্রথম হাংরি ইশতাহার প্রকাশ পাবে তাতে কবিতা, রাজনীতি, ধর্ম, দশফন, সাহিত্য, স্বাধীনতা, মানুষ, বিজ্ঞান, সমাজ, ইতিহাস, অর্থনীতি, ক্ষুধা, সংস্কৃতি, ছবি-আঁকা বিষয়ে আপনার অভিমত কি ১৯৬১-৬৫ সময়ের থেকে ভিন্ন হবে ?
মলয়: আমার 'পোস্টমডার্ন কালখণ্ড ও বাঙালির পতন' বইটার আর 'প্রমা' পত্রিকাব প্রকাশিত 'উত্তরদার্শনিকতা' নামের দীর্ঘ প্রবন্ধের জেরক্স তো তুমি নিয়েছ ? গভীরভাবে পড়লেই টের পাবে যে হাংরি বা ওই ধরনের আর কোনো কাউন্টার-কালচারাল আন্দোলন সম্ভব নয় । বিশ্ব এখন দ্রুতি-আক্রান্ত, প্রযুক্তি তাবৎ অনুমানকে ছাপিয়ে যাচ্ছে, বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় ঢুকে পড়ছে প্রতিটি সমাজের ম্যাক্রো ও মাইক্রো স্তর । যাবতীয় অ্যিধার ভাবসীমা হয়ৈ গেছে পরিধিহীন ।
ডক্টর দে: আন্দোলনের শুরুতে সম্পাদনার দায়িত্ব, প্রচার ও প্রসারের জন্য হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায়কে আবিষ্কার করেছিলেন । আজকের দিনে আন্দোলন শুরু করতে গেলে এই কাজের জন্য কাকে খুঁজে আনবেন? নেতৃত্বের জন্যই বা কোন অগ্রজকে চিহ্ণিত করবেন?
মলয়: আর কোনো অমন আন্দোলন যে সম্ভব নয় তা তো একটু আগেই বলেছি । সাব-অলটার্ন কবি-লেখকরা আজ নিজের জোরে সাহিত্য-পরিসর গড়ে নিয়েছেন । তারাই বরং সংখ্যায় বেশি । তাঁরা এনেছেন নিজস্ব শব্দভাঁড়ার, অভিয়ভক্তি, ডিকশন, ভাষাবিন্যাস । এই মুহূর্তে কবিতায় অনিকেত পাত্র আর ফিকশানে অনিল ঘড়াইয়ের নাম মনে পড়ছে ।
হাংরি আন্দোলনে আগে পর্যন্ত তুমি 'কবিতা', 'কৃত্তিবাস', 'শতভিষা' ইত্যাদি পত্রিকা দ্যাখো । নিম্নবর্গের একজন কবির কবিতাও পাবে না, কেননা, ওই শ্রেণির ভাষাকাঠামো অভিজাত সম্পাদকের স্বকৃতি পেত না । ইউরোপ তখন ওনাদের মাথায় চেপে বসেছিল । হারাধন ধাড়া বললে ওঁর অবশ্য খারাপ লাগে, কেন জানি না । তাই পালটে করেছেন দেবী রায় । হয়ত ঠিকই করেছেন ।
ডক্টর দে: 'হাংরি' এই যে অভিধা, তা একটি কবিতা বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিলে পাঠকদের সুবিধা হয় ।
মলয়: তুমি 'জখম' কবিতাটাই নাও না । ওই কালখণ্ডের পুরো বঙ্গসমাজকে নিজের হাঁ-মুখে ঢুকিয়ে নিয়েছে পাঠবস্তুটা । তারপর পংক্তির পর পংক্ত উগরে দিয়েছে পাঠকের সামনে । ওই পাঠবস্তুটি তার সর্বগ্রাসী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তখনকার তাবৎ সাহিত্যিক অনুশাসনকে অস্বীকার করে কবিতা হয়ে উঠতে চেয়েছে । পাঠবস্তুটি তার হাঁ-মুখে পোরার জন্যে কোনো বাদবিচার করছে না । পাঠবস্তুটা সে-কারণে বিষয়বস্তুহীন, শিরোনাম দিয়ে বিষয় চিহ্ণিত হচ্ছে না । তার কোনো ব্রেকফাস্ট টাইম, লাঞ্চ টাইম, ককটেল টাইম, ডিনার টাইম, পর্ব নেই । পাঠবস্তুর শুরু ও শেষ দু-ই মুক্ত । তা সর্বগ্রাসের আগে গণ্ডুষ ও শেষে আচমন করছে না । বানানের, শব্দের ও ছন্দের যথেচ্ছাচারে লিপ্ত, দু-হাতে খাবার মতন । সর্বোপরি, ওটি 'সাওয়ার হাংরি টাইমের ' কবিতা । প্রতীক বর্জিত, ছেঁড়াখোঁড়া চেবানো চিত্রকল্প, কোনটা আগে আর কোনটা পরে গ্রাস করার বালাই নেই বলে পাঠবস্তুর পংক্তিরা অনুক্রমহীন ।গোগ্রাস খাবার মতন যেখান থেকে ইচ্ছা পড়া যায় । বাইনারি অপোজিশান বা যুগ্মবৈপরীত্যের মূলকাঠামোকে চুরমার করা হয়েছে, যার দরুন হরেকরকম 'আমি' ছড়িয়ে আছে পাঠবস্তু জুড়ে, অর্থাৎ পাঠবস্তুর হাঁ-মুখও অতগুলো । 'জখম'-এর আগে দীর্ঘ কবিতা হত নদী-প্রবাহের মতো । 'জখম', পক্ষান্তরে, তৃণভূমির মতন । টৃণের মতন পংক্তিগুলো পরস্পরের সঙ্গে একযোগে যুক্ত ও বিযুক্ত । তৃণভূমির মতই এর ব্যাপ্তি বিশাল, এবং যতবার পড়বে তার বৃদ্ধি ঘটবে । লক্ষ্য করো, পাঠবস্তুটির হাঁ-মুখে ইতিহাস, ভূগোল, সমাজ, সমায়, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সবকিছু নির্বিচারে সেঁধিয়ে যাচ্ছে । ফিকশানে তুমি বাসুদেব দাশগুপ্তের 'রন্ধনশালা' পড়ো ।
ডক্টর দে: আজকের দিনের কবিতায় হাংরি আন্দোলনের সাহিত্যকৃতি প্রভাব ফেলতে পেরেছে কি ? অথাৎ আজ বহু প্রকার কবিতা লেখা হচ্ছে । সবারই নিজস্ব বোধভূবন রয়েছে । এই ভুবনে হাংরি কবিতার সাহিত্য-দর্শন বা ক্যানন প্রতিফলিত হয় কি ?
মলয়: কেবল কবিতা কেন, সাহিত্যের সব এলাকায় প্রবেশ করেছে হাংরিয়ালিস্ট ক্যানন, এমন কি পত্রিকার নামকরণেও । ১৯৬১-৬৫-র আগের ও পরের সাহিত্য বিশ্লেষণ করে দ্যাখো, তাহলেই চোখে পড়বে । শুধুমাত্র লিটল ম্যাগাজিন পরিসরে তা সীমিত নয়; বাণিজ্যিক লেখকরাও হাংরি আন্দোলন থেকে প্রচুর মাল-মশলা খড়কুটো নিয়েছেন । এই তো কয়েকদিন আগে নারায়ণ ঘোষের চিঠি পেলুম, যাতে উনি বেশ কিছু উদাহরণ দিয়েছেন । তুমি তো পি এইচ ডি করছ, তুমি আরো ভালো বলতে পারবে। এই কিছুক্ষণ আগেই একটা প্রশ্নে তুমি নিজেই বলছিলে যে হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, এমন অনেকের কবিতায় হাংরি বৈশিষ্ট্য দেখা যায় । তবে?
ডক্টর দে: ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ২০০০ সালের শেষে বিশ্ব কবিতার সংকলন প্রকাশ করেছে, মডার্ন অ্যাণ্ড পোস্টমডার্ন পোয়েট্রি অব দি মিলেনিয়াম শিরোনামে । তাতে বাংলা সাহিত্য থেকে কেবল আপনার কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে । 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতার অনুবাদ Stark Electric Jesus, তা কি এই জন্য যে আপনার সঙ্গে প্রধান-প্রধান বিট কবিদের যোগাযোগ ছিল ? ইউরোপ-আমেরিকার পত্রপত্রিকায় 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটি সে সময়ে কী ভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল ? বাঙালি সাহিত্য আলোচকরা তো সে-সময়ে কবিতাটিকে প্রাপ্য সন্মান দিতে কুণ্ঠিত ছিলেন ।
মলয়: কেবল বিটরা নন, অন্যান্য গোষ্ঠির কবিদের সঙ্গে যোগাযোগের সেতু হয়ে উঠেছিল কবিতাটা, কেননা তাঁদের সাহিত্যের প্রেক্ষিতেও একেবারে নতুন ছিল প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার । আমার সঙ্গে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, যেমন হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড, ডেভিড অ্যানটিন, রবার্ট ক্রিলি, জোয়েল ওপেনহাইমার প্রমুখের যোগাযোগ ছিল, যাঁরা ছাত্রদের ওয়র্কশপে কবিতাটা বিশ্লেষণ করেছেন ।
ড্যান ব্রাউনের 'দা ভিঞ্চি কোড' প্রকাশিত হবার পর Stark Electric Jesus একটা নতুন মাত্রা পেয়েছে । সেটা তুমি গুগল সার্চ করলে নেটে দেখতে পাবে । খ্রিষ্টধর্মীদের মাঝে কবিতাটা অন্য ব্যাখ্যা পাচ্ছে । যিশুকে তাঁরা এখন 'স্টার্ক' এবং 'ইলেকট্রিক' রূপে দেখছেন, এবং তা সেই সময়ে, যখন তিনি ক্রস নিয়ে প্যাশানে আক্রন্ত । একটি ব্যাখ্যায় কবির প্রেমিকা শুভাকে তুলনা করা হয়েছে মেরি ম্যাগডালেনের সঙ্গে ।
'কৌরব' পত্রিকার সম্পাদক আর্যনীল মুখোপাধ্যায়, যিনি আমেরিকায় থাকেন, লিখে জানিয়েছেন যে বহু ইংরেজি-ভাষী কবির কাছে তিনি এই কবিতাটার কথা শুনেছেন । আমার মনে হয় কবিতাটা নানা ভাবে ব্যাখ্যাযোগ্য বলেই হাজার বছর পূর্তি সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে । তাছাড়া, কনটেমপোরারি অথর্স অটোবায়োগ্রাফি সিরিজ-এ প্রকাশিত আমার আত্মজীবনী স্নাতক ক্লাসে 'অটো-এসে' নামের সেশানে অনেক সময়ে পড়ানো হয় ।
ডক্টর দে: 'জখম' কবিতা যখন প্রকাশিত হয়েছিল, তখন অনেকে বলেছিলেন রচনাটি গিন্সবার্গের 'হাউল' এবং 'ক্যাডিশ' এর অনুকরণে লেখা । তারপর আপনি, বিকাশ সরকার, আশেক তুহিন, শুভঙ্কর দাশ বই দুটি অনুবাদ করার পর যখন তাঁদের ভুল ভাঙল, তাঁরা বললেন, 'জখম' কবিতা ওয়াল্ট হুইটম্যানের 'লিভস অব গ্রাস দ্বারা প্রভাবিত । 'মহাদিগন্ত' পত্রিকায় (জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৯৯) কেদার ভাদুড়ির সাক্ষাৎকার নেবার সময় আপনি বলেছিলেন যে 'জখম' কবিতার টোনাল স্ট্রাকচার গঠনের সময় মাথায় ছিল ফেনটন জনসনের 'টায়ার্ড', রিচাডফ রাইটের 'বিটুইন দি ওয়ার্লড অ্যাণ্ড মি' এবং ক্রস্টোফার স্মার্টের 'জুবিলেট অ্যাগনো' কবিতাগুলো । আপনাদের সময়ে কবিতার যে সংজ্ঞা ছিল তার সঙ্গে 'জখম' কিন্তু খাপ খায় না । আপনি কি বলবেন?
মলয়: 'লিভস অব গ্রাস', 'টায়ার্ড' 'বিটুইন দি ওয়ার্লড অ্যাণ্ড মি' আর 'জুলিয়েট অ্যাগনো'-র গতিময়তা 'জখম' থেকে বর্জিত । দক্ষিণ যুক্তরাষ্ট্রের কাউবয়রা গিটার বাজিয়ে 'লিভস অব গ্রাস' গায় । 'জখম' তো বাংলা ব্যাণ্ডো গাইতে পারবে না, এমনই আপাত-অনুক্রমহীন ও নিঃছন্দ এর গঠন । বাংলা বাক্য, শ্বাসে ধরে রাখার সঙ্গে ইংরেজি বাক্য ধরে রাখার সময়-পার্থক্য আছে । তবে এটা ঠিক যে, কবিতার সংজ্ঞার আমি তোয়াক্কা করিনি 'জখম' লেখার সময় । যা ইচ্ছে, যেমন ভাবে ইচ্ছে, লিখে গেছি । কে কী বলবেন, এসব ভেবে হাংরি আন্দোলনের সময়ও লিখিনি, এখনও লিখি না । কবিতাটা নিজেই কবিতাকে সংজ্ঞাহীন করে দিয়েছে, এরকমও ভাবতে পারো ।
ডক্টর দে: তাহলে কি ধীমান চক্রবর্তী, বারীন ঘোষাল, কমল চক্রবর্তী, রঞ্জন মৈত্র, প্রণব পাল, অলোক বিশ্বাস, আর্যনীল মুখোপাধ্যায় প্রমুখের ভাষা বদলের কবিতা, অতিচেতনার কবিতা, ভাষা ভাবনার কবিতা ইত্যাদি আপনাদের খুলে দেয়া সিংহদ্বার দ্বারা উপকৃত?
মলয়; দেশ-কাল-পাত্রের দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে লেখালিখি । আমি বাণিজ্যিক বা সরকার-পোষ্য লেখালিখির কথা বলছি না । যাঁরা নিজস্ব ঢঙে লেখালিখি করতে চান, কারোর পরোয়া করেন না, তাঁদের জন্যে একটা খোলা হাওয়ার চত্বর গড়ে দিয়েছে হাংরি, শ্রুতি আর নিমসাহিত্য আন্দোলন । তুমি যাঁদের নাম বললে, তাঁরা আউটস্ট্যান্ডিং কাক করছেন । ওনাদের কবিতা পড়ে মনে হয়, পরের প্রজন্মের জন্যে আর কিছু বাকি রইল না ।
ডক্টর দে: হাংরি, অনেকে বলেন, বাংলা সাহিত্যের জলবিভাজক ঘটনা । কিন্তু হলদিয়ায় প্রতিবছর যে বিশ্ব কবিতা উৎসব হয়, তাতে আপনাকে এবং প্রদীপ চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবো আচার্য, ত্রিদিব মিত্র, সুবিমল বসাক প্রমুখকে কখনও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি । কেন?
মলয়: আমরা কারোর প্রতি অনুগত নই বলে । আমাদের কখনও যেতে বলা হয়নি । অথচ কেউ প্রশ্ন তুললে কর্তাব্যক্তিরা বলেন যে, তাঁরা নাকি প্রতিবছর আমন্ত্রণ জানান । ওটা নন্দীগ্রাম-খ্যাত রাজনীতিক লক্ষ্মণ শেঠ মশায়ের মহোৎসব ল বহু কবির জামাকাপড়ে সেসব রক্ত আর অশ্রুজল লেগে আছে ।
ডক্টর দে: আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্হ 'শয়তানের মুখ'-ও একটি সময়-চিহ্ণকারী ঘটনা । হাংরি আন্দোলনের সময়ে--১৯৬৩ সালে-- কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছিল । কৃত্তিবাসের ওয়েবসাইটে আপনার এবং এই কাব্যগ্রন্হের কোনো উল্লেখ নেই । আপনার দাদা সমীর রায়চৌধুরীর 'ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি' পখাশিত হয়েছিল কৃত্তিবাস থেকে । তাঁরও উল্লেখ নেই । পঞ্চাশবর্ষপূর্তি সংখ্যা থেকেও আপনারা দুজন বর্জিত । একে কী ভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মলয়: এটা হাংরি আন্দোলের সাফল্যের স্বীকৃতি । নয়তো দাদাকে তো বাদ দেবার কারণ ছিল না । দাদা তো কৃত্তিবাসের ফণীশ্বরনাথ রেণু সংখ্যা সম্পাদনা করেছিলেন । পত্রিকার জন্যে দীপক মজুমদারের সঠ্গে দৌড়ঝাঁপ করতেন । চাইবাসা, দুমকা, ধানবাদ, ডালটনগঞ্জ, লাহেরিয়া সরাই, ভাগলপুর, মুজফফরপুর ইত্যাদি যেখানে-যেখানে দাদার পোস্টিং হয়েছে, শক্তি-সুনীল-সন্দীপন প্রমুখ সেখানে দল বেঁধে গিয়ে দিনের পর দিন থেকেছেন । এসটাবলিশমেন্টের হাজার চেষ্টা সত্বেও হাংরি আন্দোলন যদি ছেয়ে ফেলতে থাকে তো তার দায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ।
এসটাবলিশমেন্ট চিরকালই ইতিহাসকে বিকৃত করতে চায় । শক্তি চট্টোপাধ্যাব দাদার কুঁড়ে ঘরে বছর দু-তিন ছিলেন । উনি দাদার এক শ্যালিকার প্রেমে পড়েছিলেন । সম্প্রতি মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায় আর সমীর সেনগুপ্ত চাইবাসা গিয়ে শক্তি সম্পর্কে শুটিং করে এসেছেন । আমাদের সম্পর্কে ভীতি কেন এবং কোন স্তরে কাজ করছে ভেবে দ্যাখো ।
ডক্টর দে: সাহিত্যে প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করলে চিরকালই পরবর্তী প্রজন্মকে প্রভাবিত করার কথা অনুমান করা হয় । অনেকে মনে করেন যে হাংরি আন্দোলন, যা ষাট দশকের আন্দোলন, তা ্রভাবিত করেছে পঞ্চাসের দশকের বেশ কয়েকজন কবিকে । আপনিও কি তাই মনে করেন?
মলয়: হ্যাঁ । ১৯৬১ সালের আগে লেখা ওনাদের কবিতা পড়ে দ্যাখো আর পরের কবিতা পড়ে দ্যাখো । পুরোপুরি বদলে গেছে । কবিতায় গুরুচণ্ডালী নিয়ে এলুম আমরা, ছন্দপতন নিয়ে এলুম আমরা, অথচ দাবি করছেন ওনারা । কলকাতা-পাটনা=বেনারস-কাঠমাণ্ডু ইত্যাদি শহরে রাত্রীকালীন হ্যাপেনিং শুরু করলুম আমরা, অথচ সেসব ঘটনা ওনারা নিজেদের লেখালিখিতে ঢুকিয়ে নিলেন । তোমার তো বয়স কম; পরে বিষয়টা গভীরভাবে ভেবে দেখো, বিশ্লেষণ কোরো । হাংরি আন্দোলন গিন্সবার্গকেও প্রভাবিত করেছিল, সে থত্য তুমি নেট সার্ফ করলেই পাবে ।
ডক্টর দে: রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শক্তি প্রমুখের কবিতায় প্রেমাস্পদকে গবেষকরা চিহ্ণিত করে ফেলেছেন । আমরা জেনেছি তাঁরা সব বাস্তব । কবিরা তাঁদের পাননি । আপনার কবিতায় নারীরা কি বাস্তব? না কি কাল্পনিক?
মলয়: বাস্তব । তবে, আমার প্রেমের কবিতা সেই অর্থে প্রেমের কবিতা নয়, যে অর্থে ওই তিন কবির । আমি ্রেমের মধ্যে থাকাকালীন নিজের মনঃস্হিতিতে নেশাগ্রস্ত থেকেছি । সে-কারণে একজন নারী তিন-চার বছরেই আকর্ষণ হারিয়েছেন । বা বলা যায়, প্রেমের মনঃস্হিতি ক্রমশ উবে গেছে । এটা কলেজে ঢোকার পর থেকে ঘটতে থেকেছে । অনেকে একে অনৈতিক বলবেন, স্বার্থপরতা বলবেন । 'মেধার বাতানুকুল ঘুঙুর' পর্যন্ত আমি আবিরাম প্রেমের মনঃস্হিতিতে থাকতে চেয়েছি । উপন্যাসগুলোয় বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে এই মনঃস্হিতিকে ধরবার চেষ্টা করেছি । 'মেধার বাতানুকুল ঘুঙুর' -এর নারী আমার চায়ে কুড়ি বছরের ছোট ছিলেন । প্রায়ই আত্মহত্যার হুমকি দিতেন । শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করেন, অথচ তখন তাঁর বিয়ে বাচ্চা-কাচ্চা হয়ে গেছে ।
ডক্টর দে: আপনি কখনও আত্মহত্যার কথা ভেবেছেন?
মলয়; হ্যাঁ । ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ফল আশানুরুপ না হওয়ায় । পটাশিয়াম ফেরিসায়েনাইড খেয়ে, যে কেমিকাল তখনকার দিনে বাবার ফোটোগ্রাফি ব্যবসায় প্রয়োজন হত । পিসেমশায় ধরে ফেলেছিলেন । ওরই বড়ছেলে সেন্টুদা, মানে অজয় হালদার, যাঁর কথা তুমি একবার জানতে চেয়েছিলে । শক্তিদাকে উনিই মদ খেয়ে বেহেড হবার পথে নিয়ে যান । ওই বেহেড হবার কারণেই মারা যান শক্তিদা । আমাকে পিসেমশায় আত্মহত্যা থেকে বাঁচিয়েছিলেন, কিন্তু নিজে আত্মহত্যা করে মারা যান । 'অপ্রকাশিত ছোটগল্প' বইতে 'তিনকড়ি হালদার' নামে গদ্যটা ওনাকে কিয়ে লেখা ।
ডক্টর দে: আপনার প্রবন্ধগুলো নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশের কথা ভেবে দেখেছেন?
মলয়: কেউ বের করতে চাইলে বেরোবে । আমার তো কোনো রচনার কপিরাইট নেই। কিছু প্রবন্ধ ফাইলবন্দি হয়ে আছে কবিতীর্থ প্রকাশনীর উৎপল ভট্টাচার্যের কাছে আর কিছু প্রবন্ধ আরেকটা ফাইলে আবিষ্কার প্রকাশনীর মুর্শিদ এ এম-এর কাছে, যিনি প্রচুর পরিশ্রম ও বহু টাকা খরচ করে আমার কবিতাসমগ্র ১৯৬১-২০০৪ বের করেছেন ।
(ঋণস্বীকার: সম্পাদক, স্বপ্ন পত্রিকা,নবীনচন্দ্র কলেজ, ডাক: বদরপুর, অসম ৭৮৮৮০৬ । মোবাইল নং ০৯৮৬৪৯০৮৭৯৯)
[মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা ২০০৪-১৯৬১ বইটির প্রকাশক: আবিষ্কার প্রকাশনী, ১২এ বাঁশদ্রোণীঘাট রোড
কলকাতা ৭০০০৭০, ফোন: ০৩৩-২৪১০-৫১৩২, মোবাইল: ০৯৮৩০৩৩১০৯২, দাম: ভারতীয় ১৫০টাকা]
[মলয় রায়চৌধুরীর ছোটোলোকের ছোটোবেলা বইটির প্রকাশক: চর্চাপদ পাবলিকেশন, ১৩বি রাধানাথ মল্লিক লেন, কলকাতা ৭০০০১২, ফোন: ০৩৩-২২৫৭-৩১৪৪, মোবাইল: ০৯৮৩০৩৭৯৮৪২. দাম ভারতীয়: ১৫০টাকা]
[মলয় রায়চৌধুরীর তিনটি উপন্যাস বইটির প্রকাশক: তেহাই প্রকাশনী, এবি ২৯ অটল আবাস, দেশবন্ধুনগর, বাগুইআটি, কলকাতা ৭০০০৫৯, মোবাইল: ০৯৮৩১৫৭৯৮৮২ এবং ০৯০৫১৩৬৮৯০৬. দাম ভারতীয় ২৫০ টাকা]
Labels:
উত্তর-ঊপনিবেশিকতা,
বাংলা সাহিত্য,
ষাটের দশক,
হাংরি আন্দোলন
Subscribe to:
Posts (Atom)